Poems by Kunal Biswas | Kaurab ONLINE 63/2024

 

কবিতা

কুণাল বিশ্বাস

 

বন্ধুমহল

 

ঘুরে ফিরে অবয়ব আসে, আমি দেখি

মুখের গঠন কীভাবে বদল হয়

গাছ দেখি, বাটখারা ফল

এমনই গভীর সে নেশার গুণ, রথ

ছুটে যায় মেঘে হুলুস্থুল

তবু যা নিছক টিকে থাকে ঘূর্ণমান লাগে

 

এই খালি পথ, অন্ধকার, অন্য দিক

নীচে নেমে সাক্ষ্য দেয় মৌচাক ভাঙার

 

সে উঠেছে পুরোনো মস্করা ভুলে

পরিচারিকার নামে উঠে বসে

শরবত আর টেবিলের কানাচে যে আলো

তাকে ধরে ভোর ভেবে ফেলে

 

গান চলে, তরঙ্গ বাতাস

ঘুম অভ্যন্তরে গলা বিনিময় হয়

লতায় পাতায় ঘন যমুনার তীরে

 

 

থার্ড বাই লেন, সুভাষনগর

 

গভীর জুলাই মাস আমাদের ঘরে

নুন গলে গেছে, লোকের মাথায় ছাতা

শ্রীমতি ঘোষাল আকুপাংচার করিয়ে আসবেন

একটু পরেই ওর বিবাহ বিচ্ছেদ

 

উকিল রয়েছে বসে, তিনিও সুস্থির

বাতাস প্রয়োজনের বেশি

আমরা রবীন্দ্রগান শুনতে চাইছি প্রত্যেক কথায়

শ্রীমতি ঘোষাল নিজে সুবিনয় ভক্ত

 

তিনি:

 

১.সুগার কমিয়ে সুখি

২.জয়পুর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বহু ছবি দেখেছেন

৩.মনে করেন যে পৃথিবীর সবকটা রাত গভীর সোনালি

৪.ড্রাগন ফলের চাষ করেছেন এই মরসুমে

 

চিলেকোঠা ও পৃথিবীর রোদ ডানা মেলছে এখন, দুপুর পড়বে। আমরা এও জানি,

শ্রীমতি ঘোষাল অত্যন্ত গায়িকা। তিনি গুনগুনিয়ে উঠলে আর বিকেল হবে না।

 

 

দিগন্ত

 

চূর্ণি এ-বছর বাণ এলে মাছগুলো চলে যাবে

এখন ওদের শিবির যেখানে শরণার্থী নেই

এমনকী খোদ পুঁটি তুমুল আদরে পড়ে থাকে

খেলা করে চতুর্দিক, ঘাসের যেখানে বালি কম

ভেসে থাকতে থাকতে এক ঋতু কেটে গেল

মরসুম জলের কাছে এল, উদ্ভিদের নাম খুব

পাখিদের ঠোঁটে, সমস্ত আদর পড়ে রইল ডালে

মাছরাঙা আর ওর নতুন রমণী উড়ে দেখে গেল সব

               হয়তো ওরা সমীক্ষায় ভালো

 

লেবু

 

চূড়ান্ত ঘোড়ার উপর বিশ্বাস থাকে

বাজি ধরা যায়

গান বরাবর ফোটে হাওয়া, আকাশ মলিন হল

প্রতিটা ঢেঁকুর উঠে নামে

ফলত অস্পষ্ট গন্ধ বাতাসের গায়ে

সুখ হল লেবু শুঁকে, আদতে হলুদ জীবনের

দিকে ফিরে আসে একটা বাতাবির বন

তাতে ফলে রোদ আর রোদে প্রিয় পাখি

আমার অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার বাড়তে থাকে

 

 

হাওয়া-বাতাস

 

ভয় আজ আমি বুঝে নিচ্ছি সদ্য ঘুমের ভিতর

হাঁস ঠোঁটে খেয়ে নিচ্ছে সমস্ত পুকুর

পেটফোলা ঘোলা জল ঠেলে বের হচ্ছে

ওরা আততায়ী হবে, উড়ে উড়ে বাদবাকি জল

ছেটাবে উঠোনে, ঘরে প্রত্যেকের চালে

আর তা থেকে যা বাড়তি সবুজ বনানী

আমরা যশোর রোড ভাবব

একটা বট চিরন্তন, একটা মেহগনি গণ দীপায়ন স্কুল

সব গাড়ি ছুটে যাচ্ছে ঘুমে

উচ্ছ্বসিত, মদ খোলা হবে বোতলের

ওরা থাকবে, আমিও সদল, এ জঙ্গলে

প্রিয় থোড় তুমি, অনন্য হলুদ ফুলের অনুমোদন

 

 

কবিতা ভাবনাঃ কি লিখি, কেন লিখি

 

সমবায়ী শিল্পের দিকে

 

এই মুহূর্তে লেখা শুরু হওয়ামাত্র গোল ঘড়িটার আওয়াজ আরেকবার টের পেলাম। এই একই সময়ে কোনো প্রিয়মুখ ব্যথা পেয়ে বিমর্ষ ব্যাজার। শুনলাম, তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে আরও বেশ কয়েকদিন। আনন্দিত হওয়ার কথা, শৈশবের কোনো এক মরসুমে গ্রীষ্ম পছন্দের ছিল। সত্যিই খুব গরম, পেটের সমস্যায় কাহিল সহকর্মী চিকিৎসার কারণে হায়দ্রাবাদ গেলেন, আর সঙ্গে একটু হাওয়া। ময়ূর তার ডানা গুটিয়ে আছে।

 

আপাত সংগতিহীন উপরের প্রত্যেকটা কথা উপাদান হয়ে যদি একটা কবিতা হয়, তাহলে তার রূপ ও স্বরূপ কেমন হবে ভাবলে একটা অবয়ব আসে। যার ত্বকটুকু দৃশ্যমান, এবং শল্যচিকিৎসায় পাঠক।

 

গোদার আডর্নো-পুরস্কার পাচ্ছেন, এই ঘোষণার পরে ফ্রাংকফুর্ট শহরের এক ওস্তাদ বেতারে জানিয়েছিলেন: 'ফিল্মের নন্দনতত্ত্বকে নতুন করে দিয়েছেন বলেই তাঁকে এই পুরস্কার দিয়ে আমরা কৃতার্থ হয়েছি।'

 

আরও অনেককিছুর সঙ্গে প্রসঙ্গভ্রষ্টতা, ওঁর শিল্পে অতি অবশ্যই নতুন নন্দনতত্ত্ব এনেছিল।

 

প্রথম অনুচ্ছেদে বলা কথাগুলো পরপর জুড়ে বলার সময় যে কেউ আলাদা অনেক দিগ্বলয় খুঁজে পাবে। এই সমগ্র একটা অবয়বে আসে, সুরসংযুক্ত, যা থেকে খুঁজে পেতে হয় প্রত্যেকটা আলাদা অংশ এবং তাদের উৎস।

 

গলনেও তাপ লাগে আর স্ফুটনেও

হিমাংক তখন দূরে বইয়ের ভিতর

গলনে সময় আর স্ফুটনে অধিক

সর্বদা সচল ঘড়ি দম দেওয়া

আমাদের ক্যালেন্ডার ওড়ে

ওতপ্রোত চোখদু-টো দেখে

খবরকাগজ তার জায়গাতেই

সকাল বর্ণনা হলে ঘড়ি খোলা হলে

আমরা ওর অংশগুলো চিনি

 

এই নমুনা থেকে কয়েকটা নোট খুব সহজেই পাওয়া গেল:

 

(১)তাপ বিষয়ক তিনটে প্যারামিটার, একই স্থানে, বস্তুর আলাদা অবস্থা তথা সময়কে চিহ্নিত করছে। নির্দিষ্ট বায়ুমণ্ডলীয় চাপে ফ্রিজের জমা বরফ বাইরে গলে যাওয়ায় কিংবা উনুনে ফুটন্ত জলের কাছে যথাক্রমে গলন ও স্ফুটনের প্রমাণ পাওয়া যাবে। আর ক্ষুদ্র ইঙ্গিতে বলা আছে, হিমাংক এখন উপলদ্ধ নয়। তাকে খুঁজলে বইয়ের ভিতরে সংজ্ঞা ও উদাহরণে, অন্যত্র পাওয়া যাবে। তাপ এবং হাতঘড়ি বলছে, আমরা একটা গ্রীষ্মবলয়ে আছি।

 

(২) এই ধারণার পাশাপাশি ছড়িয়ে থাকা অনেক দৃশ্যের ভিতর একটা দৃশ্য নেহাত ঘরের, যেখানে খবরকাগজ তার জায়গাতেই। হয়তো আমরা একটা টি-টেবল কিংবা সোফা দেখতে পেলাম।

 

(৩) কথাগুলো সকালের। কোনো কারণে এরপর ঘড়ি খোলা হলে আমরা ওর প্রত্যেকটা অংশ চিনি। কারণ, তারা নিত্য, সাধারণ, অমূল্য। নিজে হাতে না সারালেও ডায়াল, ফর্ক, স্প্রিং ইত্যাদি ইতিপূর্বে দেখে থাকা সম্ভব।

'সর্বদা সচল হাতঘড়ি'-ও একবার থমকাল। কারণ তার শুশ্রুষা প্রয়োজন।

লেখার সময় এর কোনো উদ্দেশ্যই মাথায় ছিল না। খুব সহজ কয়েকটা ধারণা এবং ছবির সমবায়। তাহলে পাঠকের কী দায় সে পরিশ্রম করে এই কয়েকটা লাইন থেকে এত এবং আরও অনুসিদ্ধান্ত বের করবে? সম্ভাব্য কারণ একযোগসূত্র। এইসব ধারণা এবং দৃশ্য আদতে সকালের। একটা আলো সে পাবে। 'সকাল' নামক এই সাধারণ স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে একটু ভাবনার পরে পাঠক শেষমেশ অংক মিলে যাওয়ার আনন্দ পেতে পারে।

 

মুঘলসরাই নামার আগেই আমরা উঠে যাব

এক সিট থেকে অন্য সিটে

হোঁচট খাওয়ার পর সবার মালুম হল

ট্রেন আদৌ স্টেশন ছাড়েনি

কারশেড ছাড়ার অভ্যাস ট্রেনের থাকে

চিরকাল কারশেডে ঢুকে পড়ে আর বুড়ো হয়

সেই প্রেত যে অনেক তৎপর সময়ে ছিল

ছুটন্ত চাকার উপর সমানে

সেই চাকা যার নীচে পয়সা রাখত মেয়ে

ট্রেন গেলে ছুটে যেত

উড়ে জুড়ে যেত কোঁকর কোঁ মোরগেরা

 

আমার সমস্ত মনোযোগ সরে যায় কবিতার থেকে। এতদিন ধরে একটা কলোনি আমাকে তাড়া করে যাচ্ছে। শেষত এই টুকরো নমুনা রাখলাম, কলোনির ভোরে, যা দিয়ে আমি নিজেকে সরাতে পারি দুপুরের দিকে। ভাষা ছিল আকর্ষণ, আমি তার কাছেই। বিষয়ের ধাঁচ অনুযায়ী একটা স্বরলিপি সন্ধান, সদ্য ঢালা সিমেন্ট ও বালির মিশ্রণকে চাতালের জল হয়ে এক করে তোলাএইমাত্র কাজ।

 

 

 

 কবি পরিচিতি

কুণাল বিশ্বাস-এর জন্ম ২৭ মার্চ, ১৯৯১। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পূর্ত দফতরে কর্মরত। উচ্চমাধ্যমিক অবধি পড়াশোনা ঠাকুরনগরে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে টানা চার বছর জলপাইগুড়ি, চাকরিসূত্রে পুরুলিয়া। বর্তমানে কোলকাতায় বসবাসরত কুণালের শখ সেতার ও সরোদ শোনা; চিত্রকলা, সিনেমা ও কলনবিদ্যা প্রিয়। এর আগে 'এই সময়' কাগজে রিপোর্টাজ ঘরানার কিছু গদ্য, 'কৌরব অনলাইন', 'এই সহস্রধারা', 'হাওয়া ৪৯' 'সর্বনাম' পত্রিকায় কয়েকটা গল্প, 'ভাষালিপি', 'সর্বনাম' ইত্যাদি পত্রিকা এবং 'চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম', 'আপনপাঠ', 'চলভাষ' 'তবুও প্রয়াস' ওয়েবজিনে গুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত কবিতার বই: ভ্যান গঘের প্রিয় রঙ (ভাষালিপি) এবং গোলাপে, হাওয়ার বেগে (অহিরা)।