কবিতা
দিদার
মালেকী
দিদার
মালেকী-র জন্ম ১৯৮২। পেশায়
সাংবাদিক দিদার,
একজন আপাদমস্তক
সঙ্গীতজ্ঞ। নৃতত্ত্ব
বিদ্যায় স্নাতক,
গবেষণাও চালিয়ে
যাচ্ছেন আর ইকো
ট্যুরিজমের প্ল্যান-প্রোগ্রাম।
দিদার ভ্রমণাসক্ত,
পাহাড়ে পাহাড়ে
ঘুরে বেড়ান, পার্বত্য উপজাতিদের
মধে দিন কাটাতে
ভালোবাসেন, নিচের লেখাগুলি
অনেকটা তারই প্রতিফলন।
প্রকাশিত বই:
১। তোলা
আছে প্রকৃত পানীয়
২। ছায়ার
প্রদাহ
শ্রমণ
দিনের যাপন ০১
এখনও বান
ডাকার সময় আসেনি
নদীর। রাণীখ্যং
যাবার পথ বালিময়।
হাজং পল্লী পেরিয়ে
গেলে চার্চ। সেটা
গারোদের এলাকা।
নিশ্চিহ্ন হতে
হতে টিকে আছে কয়েকটি
টিলা। এদিকটাই
সোমেশ্বরী প্রায়ই
শীর্ণা। তার স্বচ্ছতোয়া
জলরেখা। তট ভিজিয়ে
চিহ্ন রেখেছে আরও
দূর। অদূরে বর্ডার
পোস্টের ম্রিয়মান
আলো। সেটা বাঘমারা
বাজার। আমার গন্তব্য
ছিলো সে বাজার
পর্যন্ত।
মোটর সাইকেলের
একটা লুকোনো শব্দ
থাকে। চলার সময়
টের পাওয়া যায়
না। মোটরের আসল
শব্দটা এড়িয়ে গেলেই
শোনা যায়। খানিকটা
মৃগী রোগীদের গোঙানির
মতো। নতুন বাইক
চালক। বাঁক নিতে
গেলেই মনে হয়—ছেড়ে
দিলো! কিন্তু না, আমরা
পৌঁছুই ঠিকঠাক।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
একটা আশ্রমের
সামনে খোলা প্রান্তর।
কীর্ত্তন হচ্ছে।
সমানে চলছে—পদসেবা
আর ভোজ। ভ্যাপসা
গরম লাগার মতো
লোকজন। অধিকাংশই
নারী। শাড়ি পরা।
সাজগোছের চেষ্টার
কমতি নেই। এদের
সংখ্যাগরিষ্টই
খেঁটে খাওয়া। তবুও
উৎসব বলে ভরে আছে
আশ্রমাঙ্গন। কির্ত্তুনীয়ার
দল খেই হারাচ্ছে।
নারী ও শিশুর চেঁচামেচিতে।
চূনামাটির
পাহাড় শুরু। এবড়ো-খেবড়ো
সারাপথ। যাবার
পথে হাজংমাতা রাসিমণি।
মাটি, চূনামাটি—মানুষকে
গ্রহণ করে না বুঝি!
তাই মানুষের ক্ষোভ
কোদালে ভর করে!
ক্ষত-বিক্ষত একেকটি
পাহাড়। খন্ড খন্ড
বসে আছে নগরের
কারখানায় যাবে
বলে। তারপর শোভাবর্ধন—নগরের
বাড়িঘরের। কোনও
কোনও দেয়ালে হয়তো
ছবি হয়ে লেপ্টে
থাকবে এই নিশ্চিহ্ন
পাহাড়!
আর্নিস, চল্লিশ
পেরুনো গারো পুরুষ।
তার সমস্ত গল্প
মান্ধাতার। নিজের
গল্পেই সে আমায়
আবিষ্কার করার
চেষ্টা করে। দেখি
তার কথাগুলো পীতাভ।
মাঝরাতে চোখ ছোটো
হয়ে আসে। সে ঘুমোতে
চলে যায়। আমার
তখন জেগে ওঠার
সময়। দরবারি ভর
করে গলায়। বুকের
ভিতরটা শুকিয়ে
আসে। একটা বিশুষ্ক
হাওয়া বয়ে যায়।
আমার চারপাশে কে
যেন ঘুরপাক খেতে
থাকে! আর ফিসফিস
করে বলে যায়—একদিন
আমিও ছিলাম!
শ্রমণ
দিনের যাপন ০২
রাস্তা
যেখানে শেষ, হাঁটা
পথের শুরু। সে
পথে থ্যাকথ্যাকে
কাদা। গন্তব্য
ছিলো পাঁচগাঁও।
মেঘালয় সীমান্তবর্তী
গ্রাম। এটিও গারো
অধ্যুষিত এলাকা।
প্রায় সন্ধ্যে
হয়ে এলো পৌঁছুতে।
মাইলখানেক পর ছোট
এক বাজার। হাতে
গোনা কয়েকটি দোকান।
একটি মিষ্টান্নের
দোকানও পেলাম।
মিহিদানা ও রসগোল্লা
কিনে আবার হাঁটা।
ঝুম অন্ধকার চেপে
এসেছে। আরও কিছু
পথ যেতে হবে। তারপর
বর্ডার পোস্ট।
এখানেই সিমনদের
বাড়ি। রাত্রি কাটানোর
ব্যবস্থা সেখানে।
প্রতিটা
বাড়ির নিজস্ব একটা
ঘ্রাণ থাকে। সেটা
খুঁজে নিতে হয়
না। আচমকা এসে
নাকে লাগে। এই
বাড়িতে সর্বেসর্বা
এক বয়স্কা নারী।
আশি পেরিয়েছে নাকি
বছর তিন আগে। ধারালো
কথার স্বর। টনটনে
প্রখর শ্রবণশক্তি।
তার সঙ্গে জুড়েছি
গল্প। টঙ্ক আন্দোলন
থেকে মুক্তিযুদ্ধ।
বুড়ির সমস্ত স্মৃতি
যেন প্রাণ পাচ্ছে।
রাত বাড়ছে, পাল্লা
দিয়ে অন্ধকারও।
এরইমধ্যে সিমনের
ডাক। পানচক্র প্রস্তুত।
আর ডানা ঝাপটাতে
উসখুস করছে হারমোনিয়াম।
লাল চালের
ভাত আর লঙ্কাভর্তা।
মশুরি ডাল আর ভাজা
ডিম। এই ছিলো রাতের
আহার। আদতে আমার
মন মজেছে পানীয়ে।
এদের ঘরে তৈরি।
শহুরে মদের মতো
এর নেশা যাতনালব্ধ
নয়। এই নেশা এক
বৃহৎ আত্মনের দিকে
নিয়ে যায়। যেখানে
বিলীন হয়ে যায়
অপরাপর কৃত্রিম
বন্ধন। আর জেগে
ওঠে মান্ধাতার
নির্মোহী মায়া।
মানুষ সেখানে অপরের
কাছে অচ্ছুত নয়।
বরং মানুষের অধিক
জ্যন্ত। তাকে ধরা
যায়, ছোঁয়া যায়।
বোঝা যায়, সভ্যতার
ছল এদের নিশ্চল
করতে পারেনি আজও!
গলায় সুর
ভর করলে খুন হওয়ার
অনুভূতি জাগে প্রাণে!
সুর তবে এক অদৃশ্য
খুনী! গলা থেকে
তুলে নিচ্ছে স্বর।
আর বসিয়ে দিচ্ছে
কোমল ঘা। নাভিমন্ডল
থেকে বুকের গহীন।
তারপর ছেড়ে দিচ্ছে
উর্ধ্বমন্ডলে।
রাগ ভুলে যাই, মনে
পড়ে না কোনও বন্দিস।
তবুও নিজেকে বাঁচিয়ে
রাখে আলাপ। নবরাগের
সন্ধানে আসা যাওয়া
তার। আর আমি ধোপার
গাধার মতো বেঁকে
যাচ্ছি ভারে। তখন
ভৈরবী এসে ঘুম
দিচ্ছে আমায়!
ভোরে যেসব
পাখি ডাকে, তাদের
তাড়না কি ডাকার।
তবুও পাখি ডেকে
যায়। যেমন শিশু
তার মাকে ডাকে।
কারণে-অকারণে,
কেবল ডাকবার
প্রয়োজনে। আমাকে
জাগিয়ে তোলে পাখিরা।
এই তল্লাটে আমি
অভ্যাগত জানে তারা।
রাতের ভারী বৃষ্টিতে
স্নাত সকাল। কোথাও
কোনও জনরব নেই।
প্রমত্ত ছোটো এক
নদী ধাবমান। নিকটে
তবে বড়ো কোনও নদীর
চলাচল আছে। আপাত
আমাকে সে নদীর
ঠিকুজি উদ্ধার
করতে হবে।
শ্রমণ
দিনের যাপন ০৩
নদীর যেদিকে
বাঁক, বসতিহীন।
বর্ষায় এখানে লোকজন
শান্ত। দাঁড়িয়ে
দেখছি জললগ্ন দুপুর।
দূরের কোনও ঘাঁট
থেকে নৌকো আসে।
যেতে হবে কলমাকান্দা।
একরোখা জলের তোড়।
নিয়ে চলেছে কোন
এক শক্তির টানে।
সে টান অমোঘ, ভাবতে দেয় না
এমন। তামাটে সব
মুখের দেখা। বিড়ি
ফুঁকছে বুড়োদের
জটলা। পাঁচ মাইলের
বেশি দূরে বাজার।
মানুষের গায়ে আঁশটে
গন্ধ মাছের। চুপচাপ
বসে আছি নৌকোয়।
পাশ কেটে যাচ্ছে
উৎসুক মুখের দল।
আমাকে নামতে হবে
এবার। নদীর এখানে
শেষ।
সুর লেগে
আছে মুখে মুখে।
এমনই উচ্চকিত বিকেলের
বাজার। একটা কিশোরী
নাকফুল পরছে। ফেরিওয়ালার
কোনও তাড়া নেই।
দরদাম হচ্ছে, দুজনেরই
শান্ত-সমাহিত ভাব।
মেয়েটার নাম আলোকিয়া
হতে পারে। রোদ
পড়ে আসছে। বাড়ছে
মেঘের আনাগোনা।
ঠান্ডা বাতাস বয়ে
যায়। বাড়িটার কথা
মনে আসে হঠাৎ।
গভীর অরণ্যে,
যার নাম বর্ষাক্রান্তা।
চেপে এলো জোরালো
বৃষ্টি। কারওর
কোনও ভ্রুক্ষেপ
নেই। তোড়জোর নেই,
এমনই অভূত শৈত্য।
অপেক্ষা করছে একটি
বিরল সন্ধ্যা!
গৌধূলির
কোনও আলো থাকে
না। যা থাকে তার
পুরোটাই বিভ্রম!
মাঝির নাম জানা
হয়নি। নৌকো ছেড়েই
গান ধরেছে। চোখাচোখি
হতেই মুচকি হাসি।
আকাশজুড়ে ঘন দেয়া।
এই এক সময়, সব
ভুলে থাকা যায়।
সবকিছুই। শুধু
মনে আসে সুরেলা
ও সহনীয় কিছু মুহূর্ত।
নৌকো এসে পড়েছে
নাগডোরায়। এটি
একটি বাঁওড়। আরও
ঘন্টা দুয়েক পর
মধ্যনগর। তারপর
দিগন্তবিলীন জলের
বিস্তার। তার নাম
টাঙ্গুয়ার হাওড়।
প্রবল বাতাস আর
হিজলের ঘ্রাণ।
সন্ধ্যা নেমে আসছে
দ্রুত।
নারিকেল
গাছের পাতার শনশনানি।
এছাড়া সব ধ্বণি
ঘুমিয়ে পড়েছে!
ঘুটঘুটে অন্ধকার, যেখানে
নামলাম। বাতাসের
তোড় এমন, যেন
আর সব মামুলি।
দূরে কে যেন গান
ধরেছে। তার বিরহ
অমরাবতী থেকে নেমে
আসছে। তাকে সঙ্গত
দিচ্ছে থেমে থেমে
মেঘের গর্জন। এদিকে
রাত্রিযাপনের
ঠিকানা নিরুদ্দেশ!
এমন সময়ে মনে পড়ছে
তাহিতি নৃত্যের
কথা! এও যেন এক দলছুট
পলিনেশিয় দ্বীপ।
আর আমি ঘুরপাক
খাচ্ছি নর্তকীর
চক্করে! দেখছি
এই বিরল সন্ধ্যা
গ্রাস করছে পুরো
রাত!
মানুষের
রয়েছে এক গোপন
কুঠুরি। যেখানে
ব্রহ্মান্ডের
সবেরই ছিটেফোঁটা
থাকে। এই আগ্রহ
নিয়ে লোকটির নাম
শুধোই। তার পাশে
বসে থাকি। উত্তর
আসে না কোনও। আমার
ভিতরে ঘুঘু ডাকে।
জেগে ওঠে আচমকা
দুপুর। যদিও পাড়ি
দিচ্ছি মধ্যরাত।
ঝুরঝুর ঝরে পড়ছে
বুকের গহীন প্রাচীর।
লাফিয়ে বেড়াচ্ছে
আশৈশব লালিত মর্মমায়া।
কাল যেতে হবে আরও
দূরপথ। জলধারা
যেখানে করোটির
মতো আবশ্যকীয় গেঁথেছে
পাথার। ভোর হওয়ার
আগে শুধু লোকটির
নাম জানা চাই!
শ্রমণ
দিনের যাপন ০৪
সেই পাহাড়টি
দেখা যায়। জলের
শরীরে যার ছায়া
বিলীন। তার পাদদেশে
কয়লার কোয়ারি।
এই পথে রহস্য নিয়ে
রাত নামে। অন্ধকার
বাড়লে চোরাচালান
হয়। আর্দ্র হাওয়ায়
ভেসে বেড়ায় ঘ্রাণ।
মদের ঘ্রাণ, ওইপার
থেকে আসা। লোকজনের
চোখে খেলে যায়
বিদ্যুৎ। ওই সামান্য
ইশারায় চলে সমস্ত
লেনদেন। পাহাড়ের
খাঁজে-ভাঁজে বাড়ি।
তার নীচ দিয়ে কাঁটাতাঁর।
পতাকা উড়ছে না
কোনও রাষ্ট্রের
যদিও। কারওর কোনও
ভাবান্তর নেই।
আমি জানি তাদের
রয়েছে বেদনার এক
দেশ। হাতড়ে বেড়ালেও
যার হদিশ মিলবে
না কখনও!
পুরুষটির
নাম রূপেশ, তার
নারী ভূপালি। সে
রাঁধে-বাড়ে, খায় ও খাওয়ায়।
পুরুষটি পিটালে
পরেরদিন শহরে যায়।
ডাক্তারখানায়।
পথ্য নিয়ে ফেরে।
হন্তদন্ত হয়ে আবার
উনুন চাপায়। এই
গল্প শুনেছি তার
ব্যর্থ প্রেমিকের
কাছে। যার বুকের
ভিতর বিরহরেখা।
যার চোখের কোটরে
আগুন। ছেলেবেলাকার
ভালোবাসা পরিণতি
পায়নি তার। চুপচাপ
বসে থাকে চায়ের
দোকানে। দূরাগত
কাউকে পেলে তার
গল্প শোনায়। এমন
গল্প শোনার সময়
চুপ থাকতে হয়।
কী ভেবে সে থামায়
তার বলা। ওই যে
কাঁদছে ভূপালি—এই
বলে দৌড়ে চলে যায়!
বৃষ্টি
নেমেছে খুব করে।
আধেক ঘুমের ঘোরে
বোঝা যায়। যে বাড়িতে
শুয়ে আছি, আর
কেউ নেই। সে এক
উম্মাতাল নৃত্যের
ধ্বণি টিনের চালায়।
কী এক গানের কথা
মনে আসে। এরপর
মনে হয় ওই গান শুনিনি
কখনও। খুলে দেয়ার
মতো কোনও জানালা
নেই। বোঝা যায়
না বাইরের হাওয়ার
জোর। ঠিক এই সময়ে
খাবার নিয়ে আসে
সেই লোক। যার সঙ্গে
এক বাক্য কথাও
হয়নি এখনও। কম্পিত
তার ভেজা শরীর।
দেখি আমাদের মধ্যে
অদলবদল হয়ে যাচ্ছে।
দেখি আমার শরীর
ভেজা, লোকটি
বিছানায়!
রাতের
বেলা নিমপাখি ডাকে।
জ্বরের ঘোরে এ
পাখির দেখা পাওয়া
যায়। ডানা নেই
তার, অনাবৃত শরীর।
এর থেকে নিস্তার
পেতেই আপানচক্রে
বসি। সাধুদের সঙ্গে,
যারা গত হয়েছেন
শেষ মারীর আগে।
তার মধ্যে মগের
তর্কে ক্লান্ত
জেভিয়ার্স। তার
মধ্যে আমার অচেনা
জোয়াখিম। দেখি
শেষ মান্দি দেবতাও!
ওদের কারওর কোনও
রা নেই মুখে। ফের
নিমপাখি ডাকে।
এই জনপদে বড়ো এক
চোখ পাহারা দেয়
রাতে। বিগত সাধুরা
মিলে সেই চোখ উপড়ে
নিচ্ছে মত্ত অবস্থায়!
এরপর কোনও
পাহাড় নেই। শুধু
জলের বিস্তার, ফেরার
পথে। এ হলো আরেক
মাঝির নৌকো। তার
নাম জানিনি এখনও।
সে শুধু পান খায়
আর ফিকফিক করে
হাসে। গলুইয়ে শুলে
সকাল দুপুর এক
হয়ে যায়। দূরে
আড়ি পেতেছে হিজলের
সারি। দূর থেকে
দেখা যায় জলান্ধ
কোনও গ্রাম। নেমে
আসছে বিকেল, সঙ্গে বৃষ্টি।
চোখে পড়লো না একটিও
জেলে নৌকো। এ যেন
বিস্মৃতির ভাসানযাত্রা!
আমায় গ্রহণ করবে
বলে ডেকেছে জল।
দৃশ্যমাণ দূরবর্তী
লোকালয়। হ্যাঁ,
এ যাত্রায় দৃশ্যটুকুই
কেবল সম্বল!
শ্রমণ
দিনের যাপন ০৫
এখানে
মহুয়ার পালা হতো
একদা। বাড়িপিছু
জ্বলে উঠতো রেড়িতেলের
বাতি। মায়েরা কানাকানি
আড়াল করতো আত্মজ
নদীর নাম। এখানে, গল্প
থেকে নেমে আসতো
ভেলুয়া সুন্দরী।
একদা এই তল্লাটে
গল্পের জীবন ছিলো।যেখানে
যাবার কথা, ভুলে গেছি পথ।
সড়কের নীরবতা ভেঙ্গে
চলে যাচ্ছে ট্রাক্টর।
দু'পাশে শুয়ে
আছে সারের বিছানা।
মাথা উঁচু বয়েসী
অশোক। পা ঝিম ধরে
আসে। এমনই বিস্তৃত
পথ। জলের তিয়াসা
নিয়ে দুয়েকটি সারস।
কোন অলক্ষ্যের
দিকে উড়ে যায়।
ধূলিময় ওড়না কাকতাড়ুয়ার
কাঁধে। সেটি এক
নারীর প্রতিমূর্তি।
আচমকা আমার গন্তব্য
মনে পড়ে!
দুপুর, যার
থেকে সিদ্ধান্ত
আসে না কোনও। এই
সময়ে মানুষ বিভ্রান্ত
হয়। ভিতরে ভিতরে
নিজের সঙ্গে কথা
বলে। রাস্তা খোঁজে
আরও আরও আত্মগভীরে
যাবার। সে এক উম্মাদিনীর
মুখ দেখতে পাই।
একেকটি দুপুরে
ছুঁড়ে ফেলতো সমস্ত
পরিধান। একে একে
দেখাতো সভ্যতার
ফাঁক ও ফারাক।
রাস্তায়, ঘরমুখো
মানুষকে স্তব্ধ
করে দিয়ে। প্রকাশ্যে,
মানুষই কেড়ে
নিয়েছিলো তার গোপনীয়তাটুকু।
তার দুঃখের বিস্তার
জানতাম। নাকে এসে
লাগতো কেবল রক্তের
ঘ্রাণ! ফের এই পথে
ফোঁড়ন কেটে যাচ্ছে
লুপ্ত দুপুর। দূর
থেকে উস্কানি দিচ্ছে
দ্রুত গড়ানো বিকেল।
মানুষের
মন, নিকষ কালো
অরণ্য এক। একথা
মনে এলো লেঙ্গুরার
পথে। হাজং যুবাটি
মাতাল পড়েছিলো।
ওদের ছিলো বরাবরই
শান্ত জীবন। এলাকায়
মিশনারী ঢুকেছে
সদ্য। বিরোধ বাড়ছে
পাড়ায় পাড়ায়। শিশুদের
দেখতে হচ্ছে শত্রুভাবাপন্ন
ভোর! চোখের কাছে
খুন হচ্ছে আরেক
চোখ। উপাসনালয়ে,
প্রার্থনার
কালে। নারীরা ভুলতে
বসেছে কোমরসই নৃত্য।
কদর কমছে আত্মজনের।
মাতালতা বাড়ছে
যুবাদের। যত্রতত্র
বেহেড পড়ে থাকছে
রাস্তায়। যথার্থই
ক্লান্ত হয়ে ঢুকে
পড়ি এক বাড়ি। চেনা
ছিলাম খানিক,
অচেনা বেশি।
এই এক মুখভার করাদের
পাড়া। যা কিনা
আনন্দমুখর ছিলো,
এই তো সেদিন!
যে কোনও
ধর্মগুরুই আসলে
ভীরু। ভয়টা সম্পর্কে
তারা স্বচ্ছ নয়
যদিও। ধারণায় আছে, বাস্তবে
নেই। এমন বিষয়
নিয়ে কথা বলা যেত।
দেখি, এখানে
উৎসব আজ। পুরুষপ্রান্তে
জমা হচ্ছে উপচানো
যৌবন! একটি বিধবা
নারী ও তার শিশুপুত্রটি।
গুঁটিসুটি মেরে
বসে আছে। নারীটির
পরিধেয় শাদা। খসে
পড়া আঁচল তুলছে
বারবার। আরও কিছু
লোক, বসে আছে
হাতজোড়। দূর থেকে
এসব দেখছি। ক্ষণে-ক্ষণে
শোনা যাচ্ছে চাপকলের
গোঙানি! সে নারী
নেই, শিশুটি
একা। আমি আর শিশুটি
আসলেই একা! খানিক
বাদে অন্য এক নারী।
একই বেশ, একই
সে মুখের আদল।
আপাদমস্তক যেন
এক শূন্য খাঁচা।
যেন মাত্রই হারিয়েছে
শরীর। মূক ও বধির
আমি! বাক্য ছিলো
না কোনও—যা
দিয়ে সান্ত্বনা
দিতে পারি!
মানুষ
মাত্রই মানুষ বিশেষ
নয়। এটুক মাত্র
বলেই থামতে হয়।
জৈত্রির সঙ্গে
আলাপে ছেদ পড়ে।
কাছেপিঠে কোথাও
বজ্রপাত। এটা একটা
ডরমিটরি। যেখানে
একা থেকেও একাকীত্ব
থাকে না কারওর!
অদূরে নদীর পারে
বনে শিয়ালের ডাক।
প্রকৃত শিয়াল অন্ধকারেই
ডাকে! এ হলো পূর্ণমাস, তবু
জোছনাহীন চরাচর।
চুপচাপ এসে পানপাত্র
রেখে যায় লালক্রস।
শুয়ে থাকি টানটান।
চলে যাচ্ছে এক
আলো-অভেদ্য রাত্রি।
এমন রাতে নাকি
সাপের মণি দেখা
যায়! গা শিরশির
করে ওঠে। কেউ দেখেছে
একথা হলফ করে বলতে
পারলো না জৈত্রি।
মানুষের চেয়ে বড়ো
সরিসৃপ কী আছে
আর! ভাবছিলাম।
দেখি আমরা দু'টো সাপ পাশাপাশি
শুয়ে আছি!
শ্রমণ
দিনের যাপন ০৬
মধুরার
মতো আর কেউ হাসে
না। এটা ওর নাম
নয়। এ নামে ডাকলে
সাড়া মিলবে না
কারওর। হাসিটা
সত্য বলেই মধুরা
আছে। উঠতি বয়েসী
মেয়েদের শরীরে
ছত্রিশ বসন্ত।
একইসাথে বয়ে যায়, হাওয়া
দেয় অনিশ্চল। নিত্যভোরে
পালটে যায় গালের
আভা। মুখের আদলে
ভর করে সাম্রাজ্যের
আলো। ঠোঁট শুধু
নদীর মতো ঈষৎ কেঁপে
ওঠে। বুকের গভীরে
জোয়ার আসে। তার
হাসি বান ডাকে
বিশুষ্ক নদের তটে।
এসব কিছু বলছি
মেয়েটির জন্য।
যার নিকটদূরত্বে
বসে ফোটাচ্ছি বিষাদ।
ছাড়া ছাড়া বাড়ি,
যেদিকটাই এদের
নিবাস। সকালবেলা
এখানে পৌঁছে,
বসে আছি। দুপুর
গড়িয়ে গেলো ঢের
আগে। যবার কথা
কোথাও, মিলছে
না যান। যেখানে
যাচ্ছি, তার
নাম মধুরা শোনেনি
কখনও!
একটি খেয়া, অলস
বসে আছে। ওপারের
রাস্তাটা মাইল
দু'য়েক। বেলেচান্দার
দিকে সোজাসুজি
গেছে। খৈনি মুখে
গান গাইছে এক নারী।
রাস্তার দিকে মুখ
করা বাড়ি। অভ্যন্তরে
আড়ম্বর নেই কোনও।
আদতে এরা জানে—কিছুই
লুকোতে নেই। এদের
কাবু করতে পারেনি
শহুরে গুপ্তবিদ্যা।
চোখাচোখি হতেই
একগাল হাসি। এ
হলো এমন নিয়ামক, শ্রান্তি
কাটিয়ে দেয়। উঠোনে
এসে দাঁড়াতেই দাওয়ায়
পিঁড়ি। বাড়ির যেকোনও
দিকের কোণে বড়ই
গাছ থাকতে নেই।
একথা কে যেন বলেছিলো,
সম্ভবত বুড়ো।
এখানে দু'দিকেই,
ফুল পড়ে আছে
ছেয়ে। অযত্নে ফেলে
রাখা অজস্র নাকছাবি!
কুমড়ো ফুল ভাজার
ঘ্রাণ আসে নাকে।
বাড়িটির সমস্ত
কানাচ জুড়ে ছড়িয়ে
পড়ে একগাল হাসি!
ঘোড়ার
দাঁড়িয়ে ঘুমোনো
নিয়ে ভাবি। পায়ে
ফোস্কা পড়ার পর, দাঁড়াতে
হচ্ছে। বহুমূত্র
রোগীর মতো একটা
অস্থিরতা। সে কোনকালে
চুকেছে জারির আসর!
রাত্রিটির কথা
মনে এলো, যেন
প্যাঁচা দেখা।
সামনে দিগন্তবিস্তৃত
ফসলের ক্ষেত। তার
বুক চিরে এই রাস্তা।
ঘন্টা তিনেক হলো,
দ্বিতীয় মানুষটি
পড়লো না চোখে।
একটি স্কুল, অকালজীর্ণ। ক্ষণ
গুনছে ভেঙ্গে পড়ার।
একটি শশ্মান,
খালের দিকে নেমে
গেছে। রাস্তার
মোড়, একটি কুঁড়েঘরের
কিনার। মুরগীর
পশ্চাদ্ধাবন করছে
মোরগ। উজ্জ্বল
ঝুঁটি, নেতিয়ে
পড়েছে। একটি তেরো-চৌদ্দের
বালিকা। দৌড়ে পেরুলো
রাস্তা। যেদিকটা
ঢালু নেমে গেছে
বিলে। আমার আবার
দাঁড়াতে হয়। এবার
কিছুটা বুঝতে পারি—ঘোড়ার
দাঁড়িয়ে ঘুমোনোর
মানে!
একটি হলদে
পাখি বসে আছে।
নাম জানি না এমন
এক গাছ। সন্ধ্যে
নামতেই মায়েদের
হল্লা। আজ রাতে
ঠাঁই, সুভাষের
বাড়ি। তার বউ আছে,
বাচ্চা নেই।
গোটা সন্ধ্যে গেলো,
ঘরের ভিতরে কোনও
সাড়া নেই। অন্য
বাড়ি থেকে চুয়ানি
আসে। অবেলায়,
হাঁড়িভর্তি
চু। কার যে দুঃখ
ভাত পচে জমা হয়
তলে! তার বউয়ের
কথা শুধোই। ভাবি,
তারা কখনও নাগরদোলায়
চড়েছে কিনা। কোনও
এক অলৌকিক চাঁদেল
রাতে! শক্ত করে
ওর হাত ধরে রাখা
সেই বউ। সস্তার
চূড়িতে, সামান্য
আলতায় সাজিয়েছে
নিজেকে। জানি না
তার মুখচ্ছবি কেমন
হতে পারে! এমন সময়ে
সামনে আসে এক নারী।
বয়েস ধন্ধে ফেলে
এমন গড়ন তার। ঘোমটা
নেমে যাওয়া লম্বাটে
মুখ। কী নাম হতে
পারে এই নারীর!
কে যেন শীতলা বলে
ডাক দেয় তাকে! এক্ষণে
সুভাষ বলে ওঠে—আজকাল
কাঠবাদামে স্বাদ
নেই কোনও!
জারিগান
গাইছে লোকটি, ভাষাটি
অশ্রুত। ঢিমতালে
দুলছে দেহ তার।
হেসে ওঠে বর্ডার
পেরুনো বোতল! চ্যাপ্টা
মেরে সেই যে বসেছি,
নড়চড় নেই। জমায়েত
জনা দশেক বয়েসি
লোক। আসরের আলো
মিইয়ে আসে। দাওয়ায়
আমারই নিঃশ্বাস
আমাকে অবিশ্বাস
করে! এই সময়ে পাড়া
থাকে প্রায়ই খালি।
ছেলেরা সব চোরামাল
নামাতে যায় রাতে।
পালটে যায় মেয়েদের
বাজুবন্ধ। গভীর
রাতে, শঙ্খচূড়
চলাচল করে গড়খাইয়ে।
দামিনীর কথা মনে
আসে। দাওয়ায় বসে
থাকতো রাতভর। ভোরের
দিকে ফুল কুড়োবে
বলে। তাকে মালা
গাঁথতে দেখিনি
কোনওদিন! কথাচ্ছলে
কতো কী বলেছিলো
মেয়েটি! দাওয়ায়
বসলে কমে আসে ধমনীর
গতি। একরাত বসে
থেকো একা। ভুলে
যাবে তোমার লিঙ্গ!
সদাহাস্যমুখের
আড়ালে যাতনা ছিলো
ওর! যদিও কোনওদিন
তার তালাশ করিনি!
শ্রমণ
দিনের যাপন ০৭
কোনও এককালে
হাট বসতো এখানে।
সওদাপাতি নিয়ে
আসতো লোকজন। দূরদূরান্ত
থেকে এসে ভিড় করতো
নানা গ্রামের খবর।
এখন সেটা বিরান।
মড়কে জর্জরিত বুড়ো
বটগাছ। অলস চড়ে
বেড়াচ্ছে গরু ও
বাছুর। পাশে জলহীন
মরাখাল। একদা বহতা
ছিলো, গমগমে ঘাট।
প্রতিটা হাঁটের
সঙ্গে জড়িয়ে থাকে
মুন্সিগিরি। এখন
তার অবশিষ্ট কিছু
নেই। ইতঃস্তত উঁকি
মারছে কয়েকটি দোকান।
একটি রুটি কারখানা,
ঝিমোনো চিমনি।
নাপিতের চেয়ার,
হা করে থাকা
ক্ষুর। ঝিমুচ্ছে
হাড্ডিসার কুকুর।
ততোধিক সুধীর দূরের
পাহাড়। এসব দেখে
হাঁটছি, পড়ন্ত
বিকেল। এগুতে হবে
ঢের হাঁটা পথ।
যেখানে যাচ্ছি,
সেটি মুক্তছন্দপুর।
জীবন পথ
হারালে বেঁকে আসে
মানুষের পিঠ। অধিকার
করে নেয় অন্য এক
জীবন। যার সঙ্গে
তার যোগ থাকে না
মোটেও। তখন বুক
জুড়ে রোদ ঢুকে
পড়া জলের সন্তাপ।
যেমনটা জ্যৈষ্ঠের
দুপুর। একটা লোক, বসে
আছে হেলান দিয়ে।
পথ হারিয়ে ফেলা
সে লোকটি। এক পল
দেখে নিয়ে বন্ধ
চোখ। হাতে একটি
দিয়াসলতের বাক্স।
শেষ কবে শুশ্রূষা
জুটেছে তার! কোন
স্বপ্নের কাছে
বন্ধক রাখা প্রাণ!
নতুবা স্বপ্ন ছিলো
না বলেই পথ ছেড়ে
গেছে তাকে! এমনকি
জীবনও প্রায়ই ছাড়বার
পথে! পাশে গিয়ে
বসবো, পারছি
না যেতে। যেন আমার
জীবন নিয়ে কেটে
পড়ছে সে লোক! আর
তার জীবন আমাকে
বসিয়ে রেখেছে হেলানে!
প্রতিটা
পাড়ারই কিছু চোরাশব্দ
থাকে। অন্দর থেকে
বেরিয়ে আসে সেসব
শব্দ। বিশেষ করে
মাঝরাতে শোনা যায়।
প্রতিটা বাড়িরও
থাকে আলাদা আলাদা
দুঃখ। তবে তাদের
চেনা যাবে না সহজে।
এসব যখন ভাবছি, গড়াচ্ছে
সন্ধ্যে। একটি
বড়ো বন, পেরুলেই
সুলগ্নাদের বাড়ি।
তেমনই জানতাম,
দেখি সেটা ভুল।
এসে থামলাম, এটি পোড়োবাড়ি।
ভিতরে সামান্য
কিছু আলো। আর কারওর
হাঁটাচলা বোঝা
যায়। অস্ফূট ক্ষীণ
ডাক, বার্ধক্যে
উপনীতা নারীর।
যাকে ডাকছে, সাড়া নেই তার।
এ হলো সেই ডাক,
অতল গভীর থেকে
আসা। যার সাড়া
কেউ পায় না কোনওদিন!
বনের পথ ধরে হাঁটা
শুরু। আমার যাবার
পথে জলেরা দাগ
হয়ে ফুটে থাকে!
গ্রাম
জুড়ে বিনিদ্র মানুষ।
ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে
উঠছে টর্চের আলো।
যেখানে আছি, ছোটো
একটি ঘর। চারদিকে
কাঠের বেড়া। কথা
বলতে বলতে ফেরা
নারী পুরুষের দল।
কোনও একটি পালা
ছিলো এদের। যে
ধর্ম থেকে ওরা
দূরে সরেছে আগেই।
যীশুর মুখে ভর
করে হাসে তাতারা
রাবুগা! সে হাসি
শুধু বিদ্রুপের,
আন্তঃবিচ্ছেদের!
ঘুম আসে, যেন
ওইই একমাত্র আরাধ্য!
আমার চার পাশে
দেয়াংয়ের বেড়।
কে যেন ভরিয়ে তুলছে
পানপাত্র! আসরে
যোগ দেয় মিসি সালজং,
সুসমি ও গয়ড়া!
ধন্ধে পড়ি—কে
কার আরাধ্য ছিলো।
জানা যাবে না কোন
দ্রাঘিমায় আজ তাদের
ঠাঁই! বাড়তে থাকে
সতত সন্দেহ। তখনই, কার
যেন ক্রুর হাসি!
রাতের নির্জনতা
উপহাস করে যায়!
ভোরের
দিকে কে যেন ডেকেছিলো।
ঘুম ভাঙতেই এমন
মনে হলো। এই চৌহদ্দিজুড়ে
হাতে গোনা লোক।
তাদের কারওর ডাকবার
কথা নয়। ঘর ছেড়ে
বেরুতেই তুমুল
বৃষ্টি। থামবার
জো নেই কোনও। এরই
মাঝে ঢল নামছে।
বাজারের দিকে যেতে
হবে। ঘন্টা তিনেকের
পথ। তারও পনেরো
কিলো দূর হস্তীগাঁও।
সন্ধ্যের আগে আগে
পৌঁছতে হবে। বাতাস
প্রমত্ত, আর্দ্রতা
খুব। তবুও তৃষ্ণায়
শুকোচ্ছে বুক।
মাঝপথে মিলেছে
যান, অকস্মাৎ!
কথার বউনি ছাড়াই
চেপে বসলাম। খানাখন্দে
ভরা সড়ক। তার দু'পাশে কেবল জলের
বিস্তার! তারই
মাঝে মাথা তুলে
বিপন্ন ধানক্ষেত।
এসব ছাপিয়ে মোটর
চলছে, যেন কারওর
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়!
শ্রমণ
দিনের যাপন ০৮
এই সংসারে
শেষ পর্যন্ত মানুষের
কিছুই থাকে না!
যা তুলে রাখা যায়
নির্মোহের পাদপীঠে!
মানুষের আছে বেঁচে
থাকার প্রাণান্তকর
চেষ্টা। আছে খিদে, দুর্দমনীয়
যৌনতা। জীবনের
পরতে পরতে ভয়ানক
স্বার্থের সংশ্লেষ।
সাপের তবু খোল
বদলানোর থাকে।
আর মানুষের থাকছে
শুধু ভোল! নিত্য
বদলে যায় তার আসা
যাওয়া। মানুষে
মানুষে পরিবর্তিত
হয় সব সম্পর্ক।
রয়েছে ব্যাধির
মতো আত্মীয়সমাজব্যবস্থা।
নিরেট-নির্মোহ
কিছুই থাকছে তার।
এসবের পরেও কোথাও
যেতে হয় মানুষের।
এবং সে শুধু অপরাপর
মানুষের কাছেই।
তার তাড়না কেবল
নির্ভার হওয়ার।
সে জায়গাটুকু জোটে
না সবার। যাদের
জোটে তারাই পারে
অস্বীকার করতে।
অস্বীকার—এই
সংসারের, সমস্ত
মোহ-মায়ার। এমনকি
নিজেকেও তখন ভুলে
যেতে পারে মানুষ।
একটা অলৌকিক জগত
ভর করে বুকের ভিতর।
তখন আর কিছুই থাকে
না উল্লেখ করার
মতো। যা কিনা শেষ
পর্যন্ত মোক্ষ
এনে দিতে পারে!
চায়ের
তীব্র নেশা পেয়ে
বসে। এখানে মানুষের
চা-অভ্যেস নেই।
পোঁছলাম সন্ধ্যের
কিছু আগে। গ্রামে
এখনও ধূপ-ধুনো
চলে, প্রার্থনার
নয়। মশক তাড়ানোর।
কোনও কোনও নারীর
মুখে সন্ধ্যারতির
শ্লোক। সুপারি
গাছে দোল খায় হাওয়া।
কারওর তাড়া খেয়ে
দ্রুত নামছে আঁধার।
সন্ধ্যা এক অতি
আশ্চর্য সময়। মনে
পড়বেই কোনও না
কোনও বিষন্নস্মৃতি!
সে বুড়ো লোকটির
কথা মনে আসে। এমনই
সন্ধ্যায় দেখা
হয়েছিলো। অস্পষ্ট,
জড়ানো স্বর ছিলো
তার। মাঝবয়েসে
হারিয়েছিলো বউ।
সন্তানের জন্ম
দিতে গিয়ে। কোথাও
কোনও দাগ রেখে
যায়নি! সে লোকটি
হারিয়ে গেছে। সংসারে
কিছু মানুষ এমন
থাকে। যাদের আগে
পরে কেউ থাকে না।
এরা যেন শূন্য
থেকে এসে শূন্যেই
মিলিয়ে যায়। বুড়োর
সঙ্গে দেখা হয়েছিলো
এক বিষন্ন সন্ধ্যায়।
বউয়ের কথা বলছিলো।
ঝাপসা দৃষ্টি,
ছলছলে দুই চোখ।
লোনাজল ধুতে পারে
না জীবনের সব অসহায়ত্ব!
দূরে কোথাও
যাওয়ার ছিলো। কল্পচিত্রে
ভাসা ভাসা সেই
পথ। চুম্বনের ব্যবধান
রেখে সরে গেছি।
ঝুড়িতে রাখা ছিলো
শুকনো কিছু ফল।
ধারালো চাকু, পিতল
প্রলেপ দেয়া। ফেরার
কথা ছিলো একদিন।
এহেন ঘনছাওয়া বনের
পথ ধরে। তার শ্রবণে
পশে না কোনও ডাক।
এমনই সম্বিৎহারা
গোছানো কানন। আর
এক ময়ূরাক্ষীর
নদী। সজল নিবিড়
দূরে যাওয়া রাত।
কাছে আসার কথাও
ছিলো না তার। সরে
গেছি চুম্বনের
ব্যবধান বাঁচিয়ে।
পায়ের তালু নিয়ে
ভাবি। কোমলতার
চেয়ে মহৎ কী আছে
আর! কিছু আলো সহাস্য
বেরিয়ে যায়। পা
ছেড়ে, ওপরের
দিকে বেয়ে। যা
কিছু অনুজ্জ্বল,
সরাতে সরাতে
যায়। কোনও এক অলিন্দে
গিয়ে গড়ে তোলে
ঘর। আলগোছে পা
রাখলে ধ্বণিও বিলীন
হতে পারে। সে জানবে
না—আমিই ছিলাম
সেই লীন সসার।
তারপর
কেউ একটা আসে।
পূর্বাভাস ছাড়াই।
মেটেরঙ জামা গায়ে।
পিঠজুড়ে কিছুটা
সোনালি আভা। হাসলো
সারাক্ষণ। চোখে
বিদ্যুৎ ঝিলিক
নেই। চোখের পাতা
মুদে যাচ্ছে সহসা।
বিশুষ্ক ঠোঁট, কেঁপে
উঠছে খানিক। বিবশ
করছে শরীরের ঘ্রাণ।
তখনই, কে যেন
পেরুচ্ছে নদী।
সাঁতারের শব্দ,
জল কাটার। ডাকিনি,
দু'পলেই সাড়া।
যেন সাড়া দিতেই
ছিলো উম্মূখ। রাত্তিরে,
প্রমত্ত বাতাস
তখন। ডাক দিলো
ফের। শনছাওয়া বাড়ি।
পথে তার বিশল্যকরণী।
বুকের ভিতরে কে
যেন হামাগুড়ি দেয়!
ভাঙতে পারি না
পথ। সে তখন পাড়ি
দিচ্ছে এক অন্তরীপ।
এরপর বসতি শুধুই
সবুজ। বয়ে যাচ্ছে
প্রবল ঘোলাটে জল।
গভীর ঘুমে টের
পাচ্ছি এসব। স্বপ্ন
ছিলো! দূরের কোনও
এক গ্রামে হইরই।
ডাকাত পড়তে শুনিনি
যদিও। বাতাস নিয়ে
আসছে স্বর। সুর
ও সুরাময়। না-থাকা
কোনও এক সুরাইয়ার!
উপলক্ষ্য
নিয়ে পচে যায় ভাত।
তার কিছু তুলে
রাখে মদালাস্যময়ী।
আর খিঁচিয়ে তুলে
নাকমুখ। হাতের
আঙুল থেকে ঝরে
ফেনা। তার বক্রচাহনি
নিয়ে কথা বলার
আছে। কিন্তু লুঠ
হয়ে গেছে আমার
স্বর। কে যেন শব
ভেবে আমাকে ভাসিয়ে
দিচ্ছে। সেই কাঁঠালপাকার
দিনে তাকে চিনতাম।
জানতাম তার প্রলম্বিত
বেণীর বিন্যাস।
হাতের শিরা থেকে
তুলে নিতাম বিষ।
কিন্তু এখন অলক্ষ্যে
বইছে বাতাস। এসব
কিছু মনে করতে
নেই। ঘাঁড় বাঁকাতে
গেলেও ভাবতে হয়।
মাথা কাটা গেছে
সে কোন এপ্রিলে!
এরপর দেখিনি আর
কোনও মধুমাস। চরাচরে
ঝাঁকিয়ে আসছে অচ্ছুৎ
দিন। পরবের মুখে
কে যেন মেখে দিচ্ছে
মায়া! নিঃশঙ্কচিত্ত, তবু
কী এক ভয় তার। যথার্থ
ঘুম হরণ করবে একদিন!
কোনও এক বর্ষার
রাতে! আমাকে জেনে
যাবে অন্য কেউ!
উপলক্ষ্যজুড়ে
আমি নেই—বিদিশায়
নির্বান!
শ্রমণ
দিনের যাপন ০৯
মানুষের
রয়েছে একটি নিজস্ব
গান। কেউ কেউ তার
খোঁজ পেয়ে যায়।
অধিকাংশেরই মেলে
না জীবনে। আর যে
পায় সে হারিয়ে
ফেলে আর সব। এখানে
বারোমাস গান গায়
একটি লোক। বয়েস
জানে না মানুষেরা
তার। সে গান কেউ
বোঝে না এখানকার।
তার আশপাশ ঘুরঘুর
করি। উদ্ধারকৃত
যা স্বর—সে এক অজানা
ভাষার! এই সেই লোক
দেবতার অধিক। যার
আহার নিদ্রা নিয়ে
ভাবান্তর নেই কোনও।
ঘরে ফেরার কোনও
তাড়না নেই। লোকজনের
কাছে শুধিয়েও ঠিকুজি
পেলাম না। যেদিন
পূর্ণিমায় ভাসে
চরাচর, সেদিন।
লোকটিকে দেখা যায়
না কোথাও। কেউ
কেউ বলে এ হলো দেবতা
লুলাম্বা। ধরিত্রীর
প্রসবের কালে যিনি
গত হয়েছেন। আর
এখন মানুষের ভেক
ধরে বসে আছেন।
আমাকে একথা শোনাচ্ছে
এক অচেনা যুবক।
তাকেও আমার বেশধারী
লুলাম্বা বলে মনে
হয়!
একটি নারী, উঁচু
খোঁপা তার। চূড়োয়
ধরেছে সম্ভাবণাময়
মেঘ। দুপুরের শেষ
কিনারে রাস্তা
পেরোলো। পীতাভ
অনুরাগ ঝরে পড়ছে
তার। মুখ দেখা
যায় না, এমনই
ঝলসানো রোদ। পরিধেয়
আঁচল, সতর্কে
গুঁটোনো। এখানে,
পাহাড় দান করেছে
স্থৈর্যের বিবর।
তার থেকে মানুষ
কুড়িয়ে নিয়েছে
ধৈর্য। কোনও তাড়াহুড়ো
নেই কোথাও। ওঁত
পেতে নেই এমন কেউ।
অন্য কারওর জীবনে
ঢুকে পড়বার। মৃতবৃক্ষের
নিকটে বসে আছি।
দূরে কে যেন গাইছে
প্রহরান্তের গান।
অন্তঃস্থলে সে
সুর গিয়ে ছটফট
করছে। একটি রূপচাঁদা
ঝলসে উঠছে, বাজার ফেরত।
তার লোভনীয় রুপোলি
পিঠ। পাতকী হওয়ার
উস্কানি দিচ্ছে—এমনই
বাতাস। দেখতে পাচ্ছি
একটি প্রমত্ত স্বপ্নের
রাত। সে নারীর
পায়ের আলোয় উদ্ভাসিত
পথ। নিছক এটুকুই
দেখতে চেয়েছিলাম!
জীবন—আশ্চর্য
সুন্দর। একথা বলার
পর আমাকে থামতে
হলো। তিনি এক সদ্যজাগ্রতা
সোঁদাগন্ধময়ী।
যাকে বলতে যাচ্ছিলাম
আরও কিছু কথা।
যার মুখে লেগে
আছে যত্নবাঁটা
প্রলেপ। চাইলেই
সরাতে পারি সেসব।
কিন্তু আমার আঙুল
কাটা গেছে সে কোনকালে!
নারী ও তার চিত্ত
নিয়ে তর্ক জুড়তে
নেই। আমার দূর্ভাবণাগুলো
এমনই হলুদ। শুষে
নেয় অপরাপর সব
রঙ। তিনি প্রশ্ন
করলে শব্দ ঝাঁপ
দিতে চায় কূপে।
সেসব শব্দ—যা
সমুদ্রের তলদেশ
থেকে তুলে আনা।
হর্ষিত, বাঙময়
ধ্বণি তার। তাকে
উপহার দেয়া যায়
একটি সন্ধ্যা।
সে কিনা আপন লাভায়
পোড়ায় মান্দির
আসলিলতট। আর আমার
পুড়ছে এক বেদনার
দেশ। তার জানবার
কথা নয়। এসবের
তলে চাপা পড়ে থাকা
আমি কেবলই পুরুষ!
জীবন—আশ্চর্য
সুন্দর। যদিও একথা
কোনওদিন তাকে ছুঁয়ে
বলিনি।
বুড়ো আমাকে
শোনালো—প্রকৃতি
আসলে পুরুষ! শাস্ত্রে
বলেছে একথা। শুধোলাম—শাস্ত্র
বলেছেন কে তবে।
তিনি ফের বিড়িতে
আগুন নেন। বিড়বিড়
করে কী যেন আওড়ায়।
তারপর হেঁটে যায়
বেঁকে যাওয়া পথের
দিকে। বিকেলের
রঙে নিজেকে রঞ্জিত
করে কে! অক্ষিকোটরের
বিচ্ছিন্নতা নিয়ে
ভাবি। সরে যাচ্ছে
কিছু আলো। আসন্ন
সন্ধ্যাকে বরং
দেয়া যায় কিছু
দৃষ্টি। নজর এড়াতে
মাদুলি ঝুলছে গলে।
জলের হাপরে ঢুকে
পড়ছে অচর্চিত অধর।
কে যেন চিক্কণ
কণ্ঠে ডেকে যাচ্ছে।
ধরতে পারছি না
তার স্মৃতিস্বর।
ভাবতে পারছি না
তার নাম কি হতে
পারে। সে কিন্তু
ঠিক বুঝে নিচ্ছে
মাপকাঠি। জীবন
এতোটাই সুমহান, আর
সুকঠিন! আঙুল খুঁটছে
সঞ্চিত দীনতা যতো।
যা দিতে পারছি
না—নিজেকে সমস্ত
ঢেলেও!
তবে নারীর
কী থাকছে আর। এই
লোক কিংবা অন্য
লোক উদ্ভাসিত করে।
যা শেষ পর্যন্ত
পুরুষহীনতায় পুর্ণতা
পায়, এমন। তেমন
কিছুই দেখতে পাই
না। মস্তকাঘাতে
নিজেকে অভিসম্পাত
করি। দেখি, মাতৃতান্ত্রিকতা
থেকে বাদ পড়ছে
মা। আর তন্ত্র
থেকে যাচ্ছে বাড়ন্ত।
কান্না থেকে যাচ্ছে
অফুরান। যা আদর
পায় না মায়ার আঁচলের।
সেসব তন্ত্রে পেঁচিয়ে
পেঁচিয়ে বাড়ে আরও
আরও পুরুষ। এই
ভেবে ছেড়ে যাচ্ছি
বাড়ি। গত ক'রাত যেখানে ঠাঁই
ছিলো আমার। এই
লোকালয়ে তবু কৌতূহল
আছে। নারীদের,
আশরীর তন্নতন্ন
করা মস্ত কৌতূহল।
তবে তাদের নিজস্ব
পুরুষ দেখিনি কোনও!
যারা নিজেদের নারীকে
ডেকেছে নিস্তারিণী
নামে!
শ্রমণ
দিনের যাপন ১০
এরপর নদী
বাঁক নিয়েছে। তারও
দূরে আরেকটি বড়
নদী। আরও দূর গেলে
তিনটে নদীর সঙ্গম।
এরপর সম্মিলিত
জলধারা ছুটছে তীব্র
আনন্দে। দক্ষিণ-পূর্বে
তাদের গন্তব্য।
তারপর হয়তো কোনও
দেশ আছে। মানুষ
আছে, আর সব দেশে
যেমন থাকে। অজস্র-সহস্র
মানুষ। তাদের ঘর-সংসার
আছে। সন্তান-সন্ততি
আছে। মা-বাবা,
স্বজন-পরিজনও
আছে। হয়তো আছে
লুকোনো সম্পর্কের
গোপন মানুষও। আর
সবও আছে যেমনটা
থাকে। শুধু তাদের
তিনটি-দু'টি
বা একটিও নদী নেই।
তাদের নদীবিষয়ক
কোনও গাথা নেই।
জলবতী নারী আছে।
তাদের টলটলে প্রণয়
আছে। বিলুপ্ত তার
সামাজিক পরিণয়।
উৎসবের আড়ালে তবু
পরিচয় নেই। যেমনটা
নগরে লোকদেখানো
থাকে। এই থাকা
না-থাকার আবহে
নৌকো ভেড়ে ঘাঁটে।
ডাকে অচেনা মাঝি।
আমায় নিয়ে যাবে
সেই দেশে।
এ যেন এক
আরাধ্য যাত্রা।
যজ্ঞহীন, অনাড়ম্বর।
স্বপ্নাদ্য ফলের
মতো তার আবেশ।
ঘুমে ঘুমে সেই
দেশে যাই। সেখানকার
একটি মেয়ে। ক্ষীণাঙ্গী।
কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে
উপনীতা। মাথাভরা
কী যেন সুগন্ধি
ফুল তার। তার থামি
থেকে বেরিয়ে পড়ছে
সাতরঙ। পা থেকে
ঠিকরে পড়ছে আলো।
হাত দু'টো ফোটাচ্ছে
হলুদ। শুধু তার
চোখ দু'টো ম্লান।
বিলুপ্তহাসির
মুখ। যেন জ্বরাক্রান্ত
কালচে ঠোঁট। তার
সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
আনত মুখশ্রীতে
ভর করে শীতলা।
নাকে লাগে শরীরের
ঘ্রাণ। বিষন্নতায়
বিবশ হয়ে আসে মন।
মেয়েটি ফিরে যায়
সহসা। ম্লান চোখ
আরও ম্লানতর করে।
ছেয়ে আসে ফর্সা
আকাশ। গান্ধারীর
কথা মনে আসে। শতপুত্রপ্রসবা।
উপত্যকায় ছিলো
বেড়ে ওঠা তার।
সেখানেও ছিলো না
কোনও নদী। সে পুত্রগণ—মাকে
কোনও নদী উপহার
দিতে পারেনি!
সে নদীটার
উৎপত্তি নিয়ে ভাবি।
যার উজানে যায়নি
কোনও মানুষ। হয়তো
বন্ধুর সে যাওয়া।
কিংবা মানুষের
হাঁটা নদী-সহনীয়
নয়! নদীটা নিয়ে
ভাবতে থাকি। শহরে
যখন প্রাণ-সংহারি
আয়োজন। বিলোল উৎসবে
লৌলমুখের লালা
দূষিত করছে প্রদবায়ু।
পাশ ঘেঁষে যেতে
মেয়েটিকে ছোবল
মারছে ছেলেটি।
কেউ আগাপাশতলা
ঢেকে পান্থশালায়
ঢুকে পড়ছে। দু'ঢোক
গিলে মা-বাপ তুলে
নিচ্ছে নিজের।
আর তখনই খসে পড়ছে
ঝাড়বাতি। ধসে পড়ছে
সমস্ত উড়ালসম্পর্ক।
তবুও কোথায় কে
যেন জ্বালিয়ে রাখছে
সেজবাতি। নিভুনিভু
তার আলোয় নেচে
চলেছে একা নর্তকী।
তার রক্তাক্ত পা।
রসাপ্লুত করছে
কোনও এক ব্যর্থ
শাসকের চোখ। তখন
আমি নিজেকে ঠেলে
দিচ্ছি। আরেকটি
অতিযাত্রার দিকে
সজোর। প্রচন্ড
ধাক্কা এবং বঞ্চনাসমেত!
এখানে
মাসের কোনও নাম
নেই। সপ্তাহ বলতে
হাঁটবার। এখানে
পথ বলতে শুধু অসুখ।
তবে কোনও পথ্য
নেই সে পথ পেরুবার!
জীবনের এমন আয়োজন—যেখানে
মানুষের ভূমিকা
অচ্ছুত। এই সেই
অচৈতন্যবাদীদের
দেশ। যেখানে পুরুষ
মেতে থাকে মুখরা
নারীদের ফোঁড়নে।
আর নারীরা পরষ্পর
কানাকানিতে পার
করে দিন। একদা
এখানে টোল ছিলো।
গালে টোল পড়া দেবাদৃতারা
ছিলো। চতুষ্পাটি
ছিলো। প্রাঙ্গণে
খেলে বেড়াত কোমলমতিদের
কাকলি। প্রেম ছিলো
সহজ ও সাবলীল।
সম্পর্কগুলি স্থিরপ্রত্যয়।
আর যাপন ছিলো জীবনের
অধিক। আজ তবে এ
কোন দেশে এলাম।
মৃতেরা আড়াআড়ি
শুয়ে আছে! আর আমি
এক আগন্তুক গুপ্তচর।
আত্মমৃত্যুর তল্লাটে
ঘুরে বেড়াচ্ছি!
বেদনার
থেকে অব্যর্থ মহৌষধ
কিছু নেই। পাহাড়
ছাড়িয়ে এলে আরও
বেদনার্ত হতে হয়।
চোখের দূরত্ব যেখানে
শেষ, দিগন্তের
শুরু। অচেনা নদীর
সঙ্গে ভেসে গেছি
রাতে। রাতগুলি
বন্ধক রেখেছিলাম
কোনও এক সম্পন্ন
ভোরে। আঁচলভরতি
ছিলো পাড়ানির কড়ি।
আমার ভিতরে ঘুঘু
ডাকে, বিভ্রমের।
দুপুর, যে সময়টা
আলাদা করে তুলে
রাখছি। তার থেকে
বের করা কিছু সময়
উড়াল দিচ্ছে। চোখের
দ্যূতিতে জোনাকস্বপ্নের
ঋণ। পাখিনাম জপে
উড়ছে আস্ত কফিন।
উত্তরে, যেখানে
বাতাসের আনাগোনা
বেশি। তার নিকটে
বসে আমাকে ডাকে,
সে আরেক এক নদী।
আমার গভীরে পেঁপেবনের
শূন্যতা! তবুও
কবে থেকে নদীদের
গল্প তোমাদের বলে
গেছি!
===
Copyright © 2016 Deedar Maleki Published 15th Nov, 2016.