Homepage 48th Issue Content Editorial Cover Art by Partho Chanda পরিবিষয়ী কবিতা Your Comments Contact Us Books From Kaurab

   

কবিতা

আদিদেব মুখোপাধ্যায়

===  

দিদেব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৯৪। বাড়ি কোন্নগরে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন স্নাতকোত্তর পর্বে।  প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স। আদিদেবের নেশা বই ও ফিল্ম। কিছু কবিতা ও গদ্য পত্রপত্রিকায় ও আন্তর্জালিকায় প্রকাশিত।

 

 

এখানে নামছে সন্ধ্যার মতো ঘোর

 

কাপড়ের ফাঁক দিয়ে গান্ধারী শুধু নখগুলো দেখতে পেয়েছিলেন। বাকি পান্ডবেরা ভয়ে আর এলেন না তাঁর কাছে। শুধু কৃষ্ণ, অচঞ্চল ও হাসিমুখে, গান্ধারীর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। গান্ধারী তাঁকে অভিশাপ দিলেন। আমার পরিবার শুধু তোমার জন্যে আজ নষ্ট হয়ে গ্যাছে। তুমি রেহাই পাবে না’। কৃষ্ণ স্মিত হাসলেন। গান্ধারী সেই হাসি দেখতে পাননি। বাকি জীবন তিনি অন্ধ ও গাড়ল স্বামীর সাথে তপশ্চর্যায় কাটিয়ে দেবেন।

 

তারপর ছত্রিশ বছর কেটে গ্যাছে। একদিন আকন্ঠ মদ খেয়ে, ঝোঁকের মাথায়,  যাদবেরা পরস্পর তর্ক করতে শুরু করল। তারপর হাতাহাতি। তারপর রক্তারক্তি। এ তার মাথা কাটে, ও তার সাথে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়। তারপর রাগের মাথায় একটা উদ্ভিদ ছিঁড়ে নিতেই সেটা একটা মুষল হয়ে গ্যালো। অতীতে এক ঋষি অমার্জিত যাদববালকদের এই অভিশাপ দিয়েছিলেন। কেউই যা মনে রাখেনি। তারপর কী হল আমরা জানি।

 

স্থিতপ্রজ্ঞ হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি যিনি সুখেদুঃখে একইরকম নিস্পৃহ, অবিচল থাকেন। শান্ত ও ঠান্ডা স্বরে, সারথির আসনে দাঁড়িয়ে, কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন। ভিতু অর্জুন বিহ্বলচোখে তাঁকে দেখছিলেন। আমি চিনেছি, ইনিই সেই পুরুষ। নিরাবেগ, ধীমান, অচঞ্চল। অর্জুন হাতজোড় করে তাঁকে নমস্কার করেন। তারপর কৃষ্ণ হাঁ করে তাঁর সখাকে বিশ্বরূপ দ্যাখান। অর্জুনের দশটি আঙুল অবশ হয়ে যায়। ঐসময় তাঁকে দেখলে, বিশ্বাস করুন, সৌজন্য ও ডেসিবেল একটুও না মেনে, নিষাদ একলব্য হো হো করে হাসতেন।

 

প্রদুম্নহত্যার পর, দিকবিদিক ভুলে, কৃষ্ণ সেই উদ্ভিদ ছিঁড়ে হাতে নিলেন। আর ধরতেই, সেটা কঠিন ও চমৎকার একটা মুষল হয়ে গ্যালো। কৃষ্ণ চোখের সামনে যাদের দেখলেন, ‘শালাদের পিটিয়ে মারব, দাঁতে দাঁত চেপে, এই উচ্চারণ করে, রণাঙ্গণে নেমে এলেন। রক্তে পিছল হয়ে যাচ্ছিল জমি। কৃতবর্মার কাটামুন্ডু হাস্যকরভাবে শুয়ে ছিল। শবের ওপর শব জমছিল। আমাদের এই তীর্থে আজ উৎসব।

 

প্রকাশ থাক যে, যদুবংশে একটি পুরুষও বেঁচে ছিল না। শেয়ালকুকুরে দেশ ছেয়ে গেছিল। বলরাম আত্মহত্যা করেছিলেন। অসহায় কৃষ্ণ একটি তরুণ ব্যাধের হাতে নিহত হন। জীবিত নারীদের অর্জুন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, একদল দুর্বৃত্ত তাঁদের আক্রমণ করে। কুরুক্ষেত্রের বীর, দ্রোণাচার্যের প্রিয় ছাত্র, কৃষ্ণের বিশ্বস্ত অর্জুন একটি নারীকেও বাঁচাতে পারেননি। সেই লজ্জা এখনও এই দেশ বহন করছে। আর ধস নেমে, হায়, মহাপ্রস্থানের রাস্তাও বন্ধ হয়ে গ্যাছে।        

 

 

কর্কটস্বপ্ন

 

আধখোলা জানলা দিয়ে রক্তাল্প আলো আসছে। কতক্ষণ সে তার মুখ বালিশে চেপে রেখেছিল। টিকটিক করে বিকারহীন বেজে চলেছে ঘড়ি, থেকে থেকে শিউরে উঠছে স্নায়ু। পচা আনাজের গন্ধ আসছে রান্নাঘর থেকে। অবসন্ন প্রাণী আর চোখ তুলে দেখছে না, তার স্পন্দিত দেহ পড়ে আছে কার্পেটে। আলতামাখা দুটি পা, অশুভচিহ্নের মত, স্থির হয়ে, দেওয়ালে। গতরাত্রে ডাক্তার এসেছিল, সাথে ছুঁচ ও সরঞ্জাম নিয়ে। তার সৌম্য ও নির্লিপ্ত মুখ কখনও দানবের বলে ভুল হয়। করুণ চোখ তুলে সে বলেঃ

 

আমার এ ওষ্ঠ, পতনোন্মুখ পাপড়ির মত, কতদিন স্পর্শ পায়নি। আমার এ ত্বক, স্বচ্ছ ডানার মত, পতঙ্গের, কতদিন সোহাগ পায়নি। ছুঁচ থেকে একবিন্দু তরল কোথায় ছিটকে পড়ে। দুই পান্ডুর হাত, যেন অন্ধ, সামনে এগিয়ে দিয়ে, তার আলুলায়িত কেশে, স্ত্রস্ত পোশাকে, ঢেউয়ের মত সে এবার ভাঙে। মাত্রই প্রতিহত তিরের মত থরথর করে তার আমূল কেঁপে ওঠে। দানব অতিকায় থাবায় সিরিঞ্জ টেনে ধরে। সে বলেঃ

 

আমি চাই প্রেম, চাই ক্ষুরের শব্দ, চাই অভিঘাত। রাত্রির কুসুম যেমন তার অলজ্জ দলগুলি মেলে ধরে, আমি চাই তার সুখ। আলতো শব্দ করে, কখন ইশারার মত ভেঙে যায় কাচ, তরল পারা সামান্য গড়ায়। রক্তাল্প আলোয় এখন তা চকচক করছে। উৎসুক পিঁপড়েরা ভিড় করছে কাঠের টেবলে, রাত্রির পোর্সিলিনপ্লেটে। সে কেবলি শয্যায় কাঁদে গুঙিয়ে গুঙিয়ে। কুকারে তিনবার শব্দ হলে কে তার অভ্যস্ত হাতে ওভেন নিভিয়ে দ্যায়। অবসন্ন প্রাণী থাবা থেকে অল্প মুখ তোলে। খাবারের সময় হল। সে কি জানে, বহুদিন এ ঘরে টেলিফোন বাজে না। বাতাসে অন্তর্গত হয়ে থাকে আর্তি ও শ্বাস। আস্তে আস্তে পাখা ঘোরে। স্ট্যাচুর মত, শব্দহীন, কে দাঁড়িয়ে দরোজায়। সহসা গাঢ় লাল রঙে আমরা ফেড হয়ে যাই। শুধু জেগে থাকে ঘড়ির টিকটিক। বিকারহীন, তার একভাবে বেজে যাওয়া। কান্না আর ফিসফিস। ফিসফিস আর কান্না।

 

 

যাপনচিত্র

 

ব্যথা আছে গুল্মময়, শহরের নীলে। আমরা আলতো হাতে স্পর্শ করেছি তাকে, পরে ধুতে ভুলে গেছি। অস্তসময়ে আমরা বেরিয়ে পড়েছি মাঠ থেকে, হাতে ব্যাট, বগলে উইকেট; হেঁটে গেছি সরু ও বিছোনো রাস্তায়। মাথার ওপর, আকাশহীনতায়, উড়ে গ্যাছে কর্কশ পাখি। আমরা জানি আর মাত্র কয়েক পা, তারপরই জেগে উঠবে ভয়াবহ টানেল, নিরুপায় দুহাত তুলে সেখানে ঢুকে পড়ব আমরা, যার শেষ কখনো শেষ হয় না। আমরা তবু ভুলে থাকতে চেয়েছি একান্ত ইনার্শিয়ায়, ঝাঁকিয়েছি কাঁধ,  অশালীন ও তিক্ত আলাপ করেছি পরস্পর। আর এভাবে উদ্ভটতা থেকে আরো বেশি উদ্ভটতার দিকে আমরা হেঁটে গেছি। দেখিওনি, আমাদের সাথে এক-পা এক-পা করে হাঁটছে আমাদেরই ছায়া। তবু তো স্থবির ব্যাং কাদাজলে পড়ে আছে তার গুলির মতো দুইচোখ দেখেছি আমরা, দেখেছি উঠোনের এককোনে বেড়ে উঠছে বিষাক্ত আগাছা, ক্ষতের নুনছাল শুকিয়ে মিশে যাচ্ছে চামড়ায়, ঘড়ির পিছন থেকে উঁকি মারছে মেধাবী টিকটিকি। তবু তো দেখেছি মোজেজা, সমর্পিত দেহ, ক্রূর সাপ এগিয়ে যাচ্ছে কবরের দিকে। স্বাক্ষরের সাথে আমরা লিখেছি খাতায়, মৃতমানুষের সজল চক্ষু আমিও দেখেছি। বুঝিওনি, কী ঘোরলাগা জীবন কাটিয়ে যাচ্ছি আমি তুই ভাইবোন পাশের বাড়ির গাবু ও ডাক্তারবাবুসহ। তবু তো এরই মধ্যে আমাদের প্রেম, ঘৃণা, নশ্বরতা, অসুখ, উৎসব, মাঠ, সূর্যাস্ত, শেষ ছক্কা। ফিসফিসের মতো আমাদের ঘিরে বাতাস বয়ে গ্যাছে। পিচের ফাটলে জমে থেকেছে জল, চকচক করেছে আলো, আমরা দেখেছি সম্পূর্ণতা। আমাদের দুপাশে মার্চ করে চলেছে ইঁটের সারি। পথের বাঁকে, অতিকায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা সিলুয়েট ষাঁড়, দেখে আমরা প্রথমে ভয় পেয়েছি। তারপর একজন কাষ্ঠ হেসে বলেছেঃ যা ওটাকে একটা ব্লোজব দিয়ায়।আমরা হোহো হেসেছি। এভাবেই আমরা পথ খুঁজে পেয়েছি বাড়ির, নির্ণয় করতে পেরেছি দিক, আর মাত্র কয়েক পা তারপরই অমোঘ টানেল এ সত্য জেনেও পরবর্তী পদক্ষেপে সাহসী হয়েছি। ভাবিওনি, শেষরাতে ভিন্ন নারীকে ভেবে আমাদের প্রত্যেকেরই স্বপ্নদোষ হয়। তবু তো এক অনধিগম্য প্রদেশে আমরা অভিযাত্রী হয়েছি।

 

===

 

 

Copyright © 2016     Adideb Mukhopadhyay       Published 31st Aug, 2016.